Logo-UPDF

প্রাথমিক ঘোষণা

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট
(ইউপিডিএফ)

পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক অবহেলিত, দমন পীড়নে নিষ্পেষিত অশান্ত ভূ-খন্ডের নাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস যুগপৎ একদিকে নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা আর অন্যদিকে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতি দেশের অপরাপর অঞ্চল হতে ভিন্ন ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।

সুদূর অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ছিলেন বহিঃশক্তির প্রভাবমুক্ত স্বাধীন। তখনকার যুগের পরাক্রমশালী শাসকদের মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল Buffer State -এর মতো। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি কালক্রমে সারা ভারতবর্ষ গ্রাস করতে সক্ষম হলে, তাদের পরবর্তী টার্গেট হয় সীমান্তবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপনিবেশিক থাবা বিস্তার করতে চাইলে ব্রিটিশদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দীর্ঘকাল সংঘর্ষ চলে। মুঘল শাসনামলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রাখে।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক ছলাকলার কাছে এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ হেরে যান। ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে Excluded Area (বহির্ভূত এলাকা) হিসেবে মর্যাদা দেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ শাসনবিধি ১৯০০ Act (Hill Tracts Manual) প্রণয়ন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম “বিশেষ অঞ্চল” হিসেবে ১৯০০ Act অনুযায়ী আলাদাভাবে শাসিত হতো।

আন্দোলনের চাপের ফলে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি অবশেষে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ‘৪৭ সালের ভারত শাসন আইনের অনেক অনিয়ম ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পার্বত্য চট্টগ্রামের “বিশেষ মর্যাদা” অক্ষুন্ন রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ১৯০০ Act অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটা “পৃথক শাসিত অঞ্চল” হিসেবে রাখা হয়। ৬২ সালে দ্বিতীয় বার সংবিধান রচিত হলে তখন “পৃথক শাসিত অঞ্চল” শব্দের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “উপজাতীয় অঞ্চল” হিসেবে দেখানো হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি সুকৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুন্ন করে জনগণের উপর জোর জবরদস্তি চালায়। পাকিস্তানের সিকি শতাব্দী কালের শাসন ছিলো অসহনীয়।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির যে দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলার জনগণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, দেশ স্বাধীন হয়ে জনগণের সে আশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলার জনগণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির সরাসরি নির্যাতন ও শোষণ হতে মুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি বা বিজয় অর্জিত হয়নি। পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠির জায়গায় বাঙালি জনগণের মধ্য হতে উঠতি ধনিক, বণিক ও আমলা গোষ্ঠি দেশের শাসন ক্ষমতা কব্জা করে ফেলে। এই নব্য শাসকগোষ্ঠি সাধারণ জনগণের উপর আগের মতোই একটু ভিন্ন কায়দায় শোষণ নিপীড়ন শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে দেশ স্বাধীন হয়েও, সাধারণ জনগণের ভাগ্যের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি।

অন্যদিকে, দেশের এক প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অবস্থা আরো করুণ, আরো মর্মান্তিক। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির মতোই দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নব্য শাসকগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে বৈরী আচরণ করতে থাকে। পাকিস্তানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের যতটুকু অধিকার ও মর্যাদা রক্ষিত ছিলো, দেশ স্বাধীন হয়ে তাও খর্ব করা হয়। স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চালানো হয় অত্যাচার উৎপীড়নের স্টীম রোলার। বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে নিজ বাসভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার সব ধরনের ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু সংগঠনের আবির্ভাবও ঘটে। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে অনেক সংগঠন বিলীন হয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে দীর্ঘ দু’যুগের মতো নিয়মতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিক পথে লড়াই সংগ্রাম করে। প্রথমদিকে জনসংহতি সমিতি বেশ প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়।

সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে “চুক্তি” (২ ডিসেম্বর ‘৯৭) ও আত্মসমর্পণের (১০ ফেব্রুয়ারি ‘৯৮) মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে। এই সমিতির কতিপয় নেতা জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের সুবিধাবাদী রাজনীতির নর্দমায় পতিত হয়েছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চাইতে ক্ষমতাসীন দলের অনুকম্পা লাভ করে ব্যক্তিগতভাবে আখের গোছানোই হচ্ছে জনসংহতি সমিতির কতিপয় নেতার উদ্দেশ্য।

জনগণের আশা আকঙ্ক্ষার বিপরীতে কোন চুক্তি বা সমঝোতা অতীতে সুফল দেয়নি। ষড়যন্ত্রমূলক কোন ব্যবস্থাও কার্যকর হয়নি। জনসংহতি সমিতির প্রীতি গ্রুপের সাথে ‘৮৫ সালে চুক্তি ও আত্মসমর্পণ এবং ‘৮৯ -এ সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের সাথে সমঝোতা ও জেলা পরিষদ ব্যবস্থা এর জাজ্জ্বল্য উদাহরণ। “চুক্তি” ও “আত্মসমর্পণের” মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে জনসংহতি সমিতির যবনিকাপাত ঘটেছে। সময়ের দাবিতে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি দলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যে দল এই অঞ্চলের বিশেষ রাজনৈতিক ইস্যুগুলো প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম চালাবে।

কেন এই নতুন পার্টি?
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্ভাগা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সত্যিকারভাবেজনপ্রতিনিধিত্বশীল অপর কোন পার্টি বা দলের অস্তিত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকলে, আমাদের নতুন করে আর কোন পার্টি গঠনের প্রয়োজন হতো না। ‘৮৯ -এর ছাত্র জাগরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা গণতান্ত্রিক শক্তি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্বশীল পার্টিতে যুক্ত হয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতো।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কোন পার্টির অস্তিত্ব নেই। জনসংহতি সমিতি এতদিন যাবৎ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে আন্দোলন সংগ্রাম করলেও, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি ও আত্মসমর্পণ করে পুরোদস্তুর রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে। কালের আবর্তে জনসংহতি সমিতিও এ দেশের মুসলিম লীগের মতো বিলীন হয়ে যাবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবৎকালে শাসকগোষ্ঠির পরিচালিত দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে প্রগতিশীল বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সহানুভূতিমূলক বিবৃতি ছাড়া সারা দেশে উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ সংঘটিত হয়নি। নির্যাতিত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সাথে সংহতিমূলক দেশব্যাপী বড় কোন কর্মসূচী পালিত হয়নি। দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনে ও ক্ষমতা পালা বদলের পর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবার সময় শাসকগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটি গুরুত্ব দেয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ছিয়ানব্বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। নির্বাচনের ৭ ঘন্টা পূর্বে কল্পনা চাকমা অপহৃত হওয়া সত্ত্বেও চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

পার্টির লক্ষ্য ও কাজের ধারা:

আমাদের এই পার্টির লক্ষ্য হবে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব রক্ষা, নিপীড়ন-নির্যাতন ও শোষণমুক্ত একটা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

জাতিগত সাম্য, নারী-পুরুষের সমতা, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তিতে এই পার্টি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এই পার্টি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।

দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর মতো এই পার্টি সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী, ৮ম সংশোধনী, শত্রু সম্পত্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিলের দাবি জানাবে। এই পার্টি সকল ধরনের ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে এবং নিপীড়ন নির্যাতন বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে।
সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতি দানের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করবে।

এই পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অধিবাসীদের অধিকার, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের বিশেষ ইস্যু প্রাধান্য দিয়ে আমাদের পার্টি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
অনুরূপভাবে সারা দেশের নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর সাথে একযোগে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

[১৯৯৮ সালের ২৫ – ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় টিএসসি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত পিসিপি, পিজিপি ও এইচ.ডব্লিউ.এফ-এর পার্টি প্রস্তুতি সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত।]