পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইউপিডিএফ

6



ক। ভূমিকা

বর্তমান সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র যে একটি দল অনেক ত্যাগ স্বীকার করে নিরলস ও আন্তরিকভাবে নিপীড়িত নির্যাতিত জাতি ও জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, সে হলো ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা সংক্ষেপে ইউপিডিএফ। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর গঠনের পর থেকে এই পার্টিকে অনেক রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। একই সময়ে একাধিক শত্রুর বিরুদ্ধে একাধিক ফ্রন্টে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং এখনও করতে হচ্ছে। গত ২৭ বছরে পার্টির প্রায় ৪০০ নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তারপরও জনগণের আস্থাভাজন এই অদম্য পার্টির অগ্রযাত্রাকে থামানো যায়নি। শত্রুর প্রবল আক্রমণে ইউপিডিএফ ধ্বংস কিংবা দুর্বল হওয়ার বদলে বরং তার শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাগ্যবিরম্বিত অধিকারহারা জাতি ও জনগণের বাঁচার সংগ্রামে একমাত্র আশা-ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছে।

খ। কেন ইউপিডিএফ গঠন?

পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো পার্টি ও সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে, তার মধ্যে ইউপিডিএফই হলো চিন্তা-চেতনায় সবচেয়ে অগ্রসর, সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং মতাদর্শগতভাবে সবচেয়ে প্রগতিশীল। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে জনসংহতি সমিতির আত্মসমর্পনের পর জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে নিতে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে অনিবার্যভাবে এই পার্টির জন্ম হয়েছে। মূলত: তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ি গণ পরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের (এইচডব্লিউএফ) এক দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত পরিণতি হলো নতুন যুগের নতুন পার্টি ইউপিডিএফ।

গ। গঠনের পটভূমি

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ জনসংহতি সমিতির সাথে সংলাপ শুরু করে। তখন দফায় দফায় বৈঠক চলছিল। আলোচনাকে সন্তোষজনক, ফলপ্রসু ও ইতিবাচক ইত্যাদি বিশেষণ-যুক্ত করে উপস্থাপন করা হলেও, জনগণের প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসন পূরণ হওয়ার ব্যাপারে বড় ধরনের সংশয়-সন্দেহও ঘনীভূত হচ্ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ১০ মার্চ তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রথম পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে। একই দাবিতে সেদিন একটি প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। এরপর উক্ত তিন সংগঠন ঢাকায় ২৫-২৭ মার্চ তিন দিনব্যাপী আয়োজিত বিশেষ সভায় ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করে, যা পরে নতুন পার্টি গঠনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সভায় প্রতিনিধিবৃন্দ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশ সরকার ও জেএসএসের মধ্যেকার সংলাপ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জেএসএস নেতৃত্ব সংশোধনবাদীতে পরিণত হয়েছে। তিন সংগঠন “মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে” এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

পার্বত্য চুক্তির পর তিন সংগঠনের ওপর দমনপীড়ন শুরু হলে তারা ১৯৯৮ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি যৌথ সম্মেলন আয়োজন করেন এবং নতুন পার্টি ইউপিডিএফ গঠন করেন। ১৯৯০ দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা প্রসিত খীসাকে – যার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবল ছাত্র-গণ জোয়ারের সূচনা ঘটে – পার্টির আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। তারপর শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের নতুন ইতিহাস রচনা।

ঘ। আঁতুরঘরে বিনষ্টের চেষ্টা

জেএসএসের আত্মসমর্পনের পর যাতে নতুন একটি পার্টি গঠিত হতে না পারে এবং জনগণের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে, তার জন্য জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ সরকার মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায়। সরকার ও জেএসএস তিন সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হত্যা, অপহরণ, গুম ও গ্রেপ্তার শুরু করে। ইউপিডিএফ গঠনের আগে ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়িতে তৎকালীন পাহাড়ি গণ পরিষদের নেতা প্রদীপ লাল চাকমা ও কুসুম প্রিয় চাকমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয়। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি খুন করা হয় খাগড়াছড়ির আলুটিলায় হরেন্দ্র চাকমা ও হুরুক্যা চাকমাকে এবং ৮ ফেব্রুয়ারি দীঘিনালায় আনন্দময় চাকমা ও মৃণাল চাকমাকে।

অন্যদিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তিন সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে। ১১ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির নানিয়াচরে ইউপিডিএফের বর্তমান কেন্দ্রীয় সদস্য ও তৎকালীন পাহাড়ি গণ পরিষদের নেতা সচিব চাকমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তিন সংগঠনের আরও অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়।

এভাবে একের পর এক জোড়া খুন ও গণ গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্য ছিল একটাই: তিন সংগঠনকে ধ্বংস করার মাধ্যমে নতুন পার্টি ও নতুন আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে চিরতরে শেষ করে দেয়া। কিন্তু সরকার ও জেএসএসের হিসেবের অংকে ভুল ছিল। এক দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তিন সংগঠনের নেতৃত্বকে তারা খাটো করে দেখেছিল। তাই শত চেষ্টা করেও নতুন পার্টির আবির্ভাবকে তারা ঠেকাতে পারেনি।

ঙ। দুই ফ্রন্টে সংগ্রাম

নতুন পার্টি ইউপিডিএফ গঠনের পরও তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা বন্ধ করা হয়নি, বরং তা আরও জোরদার করা হয়। ইউপিডিএফ ও গণসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের খুন, গুম, অপহরণ ও গ্রেপ্তার বিরামহীনভাবে চলতে থাকে। পূর্বের মতো সরকার ও জেএসএস যৌথভাবে এই দমনপীড়ন চালায়। পার্টির আয়োজিত সভা-সমাবেশের ওপর সেনা-পুলিশী হামলা চলে। ইউপিডিএফের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত সমাবেশ পুলিশ ভণ্ডুল করে দেয়। অপরদিকে জেএসএস উক্ত সমাবেশে যোগদানে বাধা সৃষ্টি করতে খাগড়াছড়িতে সড়ক অবারোধের ডাক দেয় এবং বান্দরবানে ব্রিজের পাটাতন সরিয়ে নেয়। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকও পিছিয়ে থাকেননি, তিনি খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করেন, যাতে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে কেউ চট্টগ্রামের সমাবেশে যোগ দিতে না পারে। ১৯৯৯ সালের ২২ এপ্রিল পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ সম্মেলনে যোগ দিতে গেলে সরকার ও জেএসএস পূর্বের মতো মিলিতভাবে বাধা প্রদান করে। পুলিশ অংশগ্রহণকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে প্রতুল ও সুরমনি নামে দুই ইউপিডিএফ সমর্থককে খুন করে।

চুক্তির পর সরকার ও জেএসএস কেবল ইউপিডিএফ ও গণসংগঠনের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। জেএসএসের সম্মতিতে সরকার সাধারণ জনগণের ওপরও হামলা শুরু করে। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর দীঘিনালার বাবুছড়া বাজারে সুরলতা চাকমা নামে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করা হলে সেনাবাহিনী ও বহিরাগত সেটলাররা পাহাড়িদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। এতে চারজন নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়। পাহাড়িদের ৩৫টি দোকান লুটপাটের পর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এই হামলার প্রতিবাদে ইউপিডিএফ ২২ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেয়। কিন্তু জেএসএস এই সমাবেশ বানচালের দাবিতে মিছিল করে, ইউপিডিএফের সমাবেশের স্থানে তারাও পাল্টা সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দেয় এবং ইউপিডিএফের সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে জেলা প্রশাসকের প্রতি আহ্বান জানায়। তাদের এই দাবি যথারীতি পূরণ করে জেলা প্রশাসক ২১ অক্টোবর বিকেলে ১৪৪ ধারা জারি করে।

বাবুছড়া হামলার পর পাহাড়িদের ওপর আরও অনেক জায়গায় অনেক বার হামলা হয়। যেমন ১৮ মে ২০০১ বোয়ালখালি (দীঘিনালা) হামলা, ২৫ জুন ২০০১ রামগড় হামলা, ১০ অক্টোবর ২০০২ রাজভিলা (বান্দরবান) হামলা, ১৯ এপ্রিল ২০০৩ ভূইয়োছড়ি (খাগড়াছড়ি সদর) হামলা, ৩ এপ্রিল ২০০৬ মাইসছড়ি হামলা, ২৬ আগস্ট ২০০৬ মহালছড়ি হামলা, ২০ এপ্রিল ২০০৮ সাজেক হামলা, ১৯-২০ এপ্রিল ২০১০ সাজেক দ্বিতীয় হামলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ খাগড়াছড়ি হামলা, ১৭ এপ্রিল ২০১১ শনখোলা পাড়া হামলা, ১২ অক্টোবর ২০১১ তাইন্দং হামলা, ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ রাঙ্গামাটি হামলা, ২৫ জুন ২০১৩ মাটিরাঙ্গা হামলা, ৩ আগন্ট ২০১৩ তাইন্দং হামলা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ বগাছড়ি (নানিয়াচর) হামলা, ২ জুন ২০১৭ লংগদু হামলা, ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি হামলা, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ গুইমারা হামলা। এক হিসেবে চুক্তির পর গত ২৮ বছরে পাহাড়ি জনগণের ওপর ২৫টির মতো বড় ধরনের সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে।

অনেক হামলার লক্ষ্য ছিল পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে তাদের ভূমি বেদখল করা। বাস্তবত পার্বত্য চুক্তির পর ভূমি সমস্যার সমাধান হওয়ার পরিবর্তে বরং ভূমি বিরোধ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। মাইসছড়ি, মানিকছড়ি, দীঘিনালা, লংগদু, লামাসহ তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন জায়গায় ভূমি বেদখল এখন নিত্যনৈমিত্ত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউপিডিএফ একদিকে সরকার ও জেএসএসের হামলার মোকাবিলা এবং অন্যদিকে সেটলার হামলা, ভূমি বেদখল ও জাতিগত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে পাহাড়ি নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ – এই দুই ফ্রন্টে যুগপৎ সংগ্রাম জারী রাখতে বাধ্য হয়। এই সংগ্রাম আজও চলছে।

চ। জেএসএসের সাথে আলোচনা-সমঝোতা

সঠিক নীতি কৌশলের ভিত্তিতে দুই ফ্রন্টে যুগপৎ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফের শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেএসএসের প্রতি ইউপিডিএফের ঐক্য ও সমঝোতার আহ্বান আপামর জনগণ এবং বিদেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের আন্তরিক সমর্থন লাভ করে। ফলে জেএসএস বিভিন্ন সময় চাপে পড়ে ও কোনঠাসা হয়ে ইউপিডিএফের সাথে আলোচনায় বসতে ও সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। তাই ২০০০, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১৮ সালে দুই পার্টির মধ্যে চার বার সমঝোতা হয়। তবে প্রতিবারই জেএসএস সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করে নতুন করে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত শুরু করে।

ইউপিডিএফ মূলত জনগণের ওপর নির্ভর করে জেএসএসের হামলা মোকাবিলা করার নীতি গ্রহণ করে এবং এতে সফল হয়। ইউপিডিএফকে নির্মূল করা জেএসএসের লক্ষ্য হলেও এবং শুরুতে “ইউপিডিএফের সাথে কোন আলোচনা নয়” এমন নীতি গ্রহণ করলেও সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় কোনঠাসা হয়ে পড়লে জেএসএস নেতৃত্ব নিজেই ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতে বাধ্য হয়।

ছ। সরকারের সাথে সংলাপ

সরকার ও সেনাবাহিনী বার বার চেষ্টা করেও ইউপিডিএফকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। পার্টির অসংখ্য নেতাকর্মী ও সমর্থককে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করা, দলচ্যুত কর্মীদরে দিয়ে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন ও তাদেরকে লেলিয়ে দিয়ে খুন, অপহরণ, গুম, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি দমনমূলক পদক্ষেপ সত্বেও পাহাড়ে ইউপিডিএফের পতাকা সগৌরবে উড্ডীন থাকে। এই অবস্থায় সরকার এক নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হয় – সেটা হলো রাজনৈতিক সংলাপ।

২০২১ সালের ২৪ মার্চ ও ১০ এপ্রিল দুই দফায় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ইউপিডিএফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইউপিডিএফ ২০২২ সালের ৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট দাবিনামা হস্তান্তর করে। তবে এরপর আওয়ামী লীগ সরকার পার্টির সাথে আর কোন বৈঠক আয়োজন করেনি। বৈঠকে সরকারী প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে সরকার যে আদৌ আন্তরিক ছিল না, তা সংলাপ প্রক্রিয়া চালু না রাখার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে।

জ। কেন সেনা শাসকগোষ্ঠী ইউপিডিএফকে ধ্বংস করতে চায়?

ইউপিডিএফ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র পার্টি যার নেতাকর্মীরা জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ইউপিডিএফ সাফল্যের সাথে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর জুম্ম ধ্বংসের নীতি বাস্তবায়নের পথে একমাত্র বাধা হলো ইউপিডিএফ। তাই দেশের প্রত্যেকটি সরকার ও সেনাবাহিনী এই বাধা দূর করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে থাকে। জনগণের আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করতেই সেনা শাসকগোষ্ঠী ইউপিডিএফকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু ইউপিডিএফের গণ সমর্থনের ভিত্তি অনেক গভীরে প্রোথিত এবং পার্টির নেতাকর্মীরা জনগণের সাথে সুখে-দুঃখে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই এই পার্টিকে গত ২৭ বছরে নির্মম দমনপীড়ন চালিয়েও ধ্বংস করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না।

ঝ। জাতীয় পরিসরে ইউপিডিএফ

ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি দল হলেও জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনেও তার বিচরণ রয়েছে। ইউপিডিএফ গঠনের আগে ১৯৯০ দশকে পার্টির নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনকে সারা দেশের মুক্তিকামী জনগণের আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং এতে সফলও হয়েছিলেন। তারা সংগ্রামের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ওপর চলা শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অত্যাচারের প্রতি প্রগতিশীল জাতীয় রাজনৈতিক দল, সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা ও মানবতাবাদী বিশিষ্টজনের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ইউপিডিএফ এক সময় জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে গঠিত একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক জোটের সাথে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা বিরোধী ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানেও ইউপিডিএফ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতেও পার্টি ও তার সহযোগি সংগঠনগুলো বিভিন্ন মাত্রায় সক্রিয় রয়েছে।

ঞ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ

ইউপিডিএফ একটি স্বীকৃত গণতান্ত্রিক দল এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই পার্টি জনগণের দাবি আদায়ের সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। পার্টি গঠনের অনেক আগেও ইউপিডিএফের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের মতো ইউপিডিএফ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং স্থানীয় উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচেনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। আগামী বছর ১২ ফেব্রুয়ারি (২০২৬) অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইউপিডিএফ অংশগ্রহণ করবে।

ইউপিডিএফের এই গণতান্ত্রিক কার্যক্রম সত্বেও শাসকগোষ্ঠী দমনপীড়নের মাধ্যমে তার গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত করে চলেছে। পার্টিকে সভা সমাবেশ করতে দেয়া হয় না, তার সকল অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং কোন প্রকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই পার্টিকে চালাতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি যাতে কোনভাবে গড়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ড. ইউনূস সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ প্রক্রিয়া থেকে ইউপিডিএফের প্রতিনিধি মাইকেল চাকমাকে সরিয়ে রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে আদালতকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার হয়ে আয়নাঘর নামক গোপন বন্দীশালায় আটক ছিলেন। হাসিনার পতনের পরই কেবল তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর তিনি দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন এবং মিডিয়ায় পার্বত্য জনগণের অলিখিত মুখপাত্রে পরিণত হন। তার সক্রিয়তার কারণে দেশে বিদেশে ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে থাকলে তিনি সেনা শাসকগোষ্ঠীর চক্ষশূলে পরিণত হন। অবশেষে তারা তার মুখ বন্ধ করে দিতে ক্যাঙ্গারু কোর্টে প্রসহনসূলক এক তরফা বিচারে তাকে সাজা দেয়।

ট। জনকল্যাণমূলক কাজে ইউপিডিএফ

ইউপিডিএফ কেবল সভা-সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, এই পার্টি জনসেবা, জনকল্যাণ ও জনসচেতনতামূলক আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমও পরিচালনা করে থাকে। ইউপিডিএফ জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা ও জীবিকার মান উন্নয়নেও সচেষ্ট। আর্থ-সামাজিক যেসব ক্ষেত্রে পার্টি কাজ করে থাকে তার কয়েকটি হলো:

১) বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা। ইউপিডিএফ আজ পর্যন্ত ৮০টির মতো স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে বা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা প্রদান করেছে। পার্টি প্রতিষ্ঠিত অনেক স্কুল এখন সরকারী রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়েছে। ২) বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান। ৩) বিনামূল্যে শীতবস্ত্র বিতরণ। ৪) দুঃস্থ ও গরীবদের মধ্যে বিনামূল্যে চাল-ডালসহ খাদ্যসামগ্রী বিতরণ। ৫) বিনামূল্যে ফলজ ও ঔষধী চারা বিতরণ। ৬) গরীব চাষীদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান, জমিতে সেচের জন্য বাঁধ নির্মাণ। ৭) যুব সমাজের মধ্যে খেলাধূলার সামগ্রী বিতরণ ও খেলাধূলার আয়োজন। ৮) মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৯) জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্য ব্রিজ, সাঁকো নির্মাণ। ১০) গরীব চাষীদের ফসল কেটে ঘরে তুলে দেয়াসহ বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সহযোগিতা প্রদান। ১১) বন্যা, ইঁদুর বন্যা ও মহামারীসহ প্রাকৃতিক দুযোগ এবং সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান। ১২) বিভিন্ন সময় চোরাইপথে নিয়ে আসা ফেনসিডিলসহ মাদকদ্রব্য জব্দ করে ধ্বংস করা।

ঠ। পরিবেশ রক্ষায় ইউপিডিএফ

পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ও পরিবেশ রক্ষায় ইউপিডিএফ অত্যন্ত সচেতন এবং এ বিষয়ে তার বাস্তব কর্মসূচি রয়েছে। ইউপিডিএফ জনগণকে জুম চাষ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছ (যেমন সেগুন, ইউক্লিপটাস) লাগাতে নিরুৎসাহিত এবং এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে থাকে। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে জনসচেতনতামূলক সভার আয়োজন, পোস্টারিং এবং প্রচারপত্রও সময়ে সময়ে বিলি করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা হয় এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এসব বর্জ্য সাফ করা হয়। বন্য প্রাণী সংরক্ষণেও ইউপিডিএফ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ইউপিডিএফের বন ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচির কারণে কাউখালিসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক বন ও বন্য প্রাণী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

ড। উপসংহার

অনেক বাধা-বিপত্তি ও দমনপীড়ন সত্বেও ইউপিডিএফ এগিয়ে চলেছে। আন্দোলনের অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত হয়ে পার্টির নেতাকর্মীরা সাচ্চা বিপ্লবী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট রয়েছে। জনগণের যে কোন আন্দোলন সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো তার নেতৃত্ব। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। আর কেবলমাত্র ইউপিডিএফের মতো উন্নত মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত ও সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী দ্বারা সুসজ্জিত একটি পার্টিই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে। ইউপিডিএফের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত সকল জাতি ও জনগণ একদিন অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কোন অপশক্তি ইউপিডিএফের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করতে পারবে না। (সমাপ্ত)

—-